বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর ? সাম্রাজ্যবাদ এবং ইতিহাস

বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর ? প্রিয় পাঠক বন্ধু,  ব্রিটিশ শাসনের কারনে বাংলায় কি কি প্রভাব পড়েছিল চলুন দেখে নি, আর্টিকেল টি শেষ পর্যন্ত পড়লে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন। 

ব্রিটিশরা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে (১৭৫৭-১৯৪৭) বাংলা শাসন করেছিল। এই দীর্ঘ সময়কালে, বাংলা সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল।

ইতিবাচক প্রভাব:

  • শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার: ব্রিটিশরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, যার ফলে বাংলায় শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায় এবং জ্ঞানের প্রসার ঘটে।
  • আইন ও বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন: ব্রিটিশরা আইন ও বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছিল, যা আগের তুলনায় বেশি ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ ছিল।
  • অর্থনৈতিক উন্নয়ন: ব্রিটিশরা বাংলায় আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, যার ফলে বাণিজ্য ও শিল্পের বৃদ্ধি ঘটে।
  • পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: ব্রিটিশরা রেল, রাস্তাঘাট, এবং নৌপথ নির্মাণ করে বাংলায় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছিল।
  • সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশ: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। নবজাগরণের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা হয়।

নেতিবাচক প্রভাব:

  • শোষণ ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি: ব্রিটিশরা বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল এবং জনগণকে শোষণ করেছিল। এর ফলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।
  • কৃষি অর্থনীতির ক্ষতি: ব্রিটিশরা বাংলার কৃষি অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। তারা নীল চাষের জন্য জমি দখল করেছিল এবং চাষীদের উপর শোষণমূলক কর আরোপ করেছিল।
  •  ব্রিটিশদের বাধা: ব্রিটিশরা বাংলায় নানা ভাবে বাধা দিয়েছিল। তারা চাইছিল না যে বাংলায় শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং ব্রিটিশ শিল্পের সাথে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।
  • সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি: ব্রিটিশরা বাংলা সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি করেছিল। তারা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল।
  • স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রক্তপাত: ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিরা দীর্ঘ ও তীব্র সংগ্রাম করেছিল। এই সংগ্রামে অসংখ্য বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসনের বাংলায় ব্যাপক প্রভাব ছিল। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই ছিল। ব্রিটিশরা বাংলায় আধুনিক শিক্ষা, আইন, অর্থনীতি, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভাব ফেলে |

ব্রিটিশ শাসন আমলে বাংলা
বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর

ব্রিটিশ শাসন আমলে বাংলা? ব্রিটিশ শাসন আমলে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ

ব্রিটিশ শাসন আমল (১৭৫৭-১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই দীর্ঘ সময়কালে, বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।

পরিবর্তনের কারণ:

  • নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা: ব্রিটিশরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, যার ফলে বাঙালিরা ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে। এর প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা হয়।
  • মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন: মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলনের ফলে সাহিত্যকর্ম সহজে প্রকাশ ও বিতরণ করা সম্ভব হয়। এর ফলে সাহিত্যের প্রসার ঘটে।
  • সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন: ব্রিটিশ শাসন আমলে বাংলা সমাজে ও রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। এই পরিবর্তনগুলি সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়।

প্রধান ধারা:

  • নবজাগরণ: ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা হয়। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এবং আক্ষয়চন্দ্র সেন প্রমুখ লেখক নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন। নবজাগরণের মূল ভাবধারা ছিল ধর্মীয় সংস্কার, সমাজ সংস্কার, এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান।
  • রোমান্টিকতা: নবজাগরণের পাশাপাশি রোমান্টিকতার ধারাও বাংলা সাহিত্যে বিকশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি রোমান্টিক ধারার অন্যতম প্রতিনিধি। রোমান্টিক কবিতায় প্রকৃতি, ভাব, এবং কল্পনার উপর জোর দেওয়া হত।
  • বাস্তববাদ: বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে বাস্তববাদের ধারা বিকশিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক বাস্তববাদী ধারার অন্যতম প্রতিনিধি। বাস্তববাদী সাহিত্যে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হত।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ধারা:

  • প্রহসন: দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইস্পাহানী, এবং রমাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক প্রহসন রচনা করেছিলেন।
  • নাটক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এবং মুজতবা রহমান প্রমুখ লেখক নাটক রচনা করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি কয়টি

ব্রিটিশ আমলে সাধীনতা সংগ্রাম?

ব্রিটিশ শাসন (১৭৫৭-১৯৪৭) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই দীর্ঘ সময়কালে, ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্য দীর্ঘ ও তীব্র সংগ্রাম করেছিল। এই সংগ্রাম বিভিন্ন রূপে ধারণ করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে:

শুরুর দিকের প্রতিরোধ:

  • ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ: ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় আন্দোলন ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ।
  • ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রভাব: এই বিপ্লবগুলি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করেছিল।
  • ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলন: রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এবং স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ সংস্কারক জাতীয় চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বিশ শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন:

  • ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৫): ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন।
  • অসহযোগিতা আন্দোলন (১৯২০): মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে, ভারতীয়রা ব্রিটিশ পণ্য বর্জন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্ম বর্জন করেছিল।
  • স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য ধারা:
  • খিলাফত আন্দোলন: মুসলিমরা তুর্কি খিলাফতের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিল।
  • চৌরি-চাউরা ঘটনা (১৯২২): পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিহত হওয়ার পর, গান্ধী অসহযোগিতা আন্দোলন স্থগিত করেছিলেন।
  • সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স আন্দোলন (১৯৩০): গান্ধী লবণ Satyagraha-র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে ভারতীয়রা ব্রিটিশ লবণ কর আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল।
  • ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): “ভারত ছাড়ো” স্লোগানের অধীনে, ভারতীয়রা ব্রিটিশদের তাৎক্ষণিক প্রস্থানের দাবি জানিয়েছিল।

সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও স্বাধীনতা:

  • হিন্দু-মুসলিম বিভাজন: ব্রিটিশরা ভারতকে হিন্দু-প্রধান ভারত এবং মুসলিম-প্রধান পাকিস্তানে বিভক্ত করে।
  • ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা: ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের বিভাগ কয়টি ও কি কি

ব্রিটিশ আমলে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন?

ব্রিটিশ শাসনামলে (১৭৫৭-১৯৪৭) বাংলার পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধিত হয়।

প্রধান পরিবর্তনগুলি ছিল:

ব্রিটিশরা বাংলায় ব্যাপক কিছু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করে গেছেন। চলুন দেখে নি কি কি অবদান সেই গুলো।

সড়ক নির্মাণ:

  • ম্যাকডাম রাস্তা: কলকাতা থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, এবং অন্যান্য প্রধান শহরগুলিকে সংযোগকারী ম্যাকডাম রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল।
  • গ্রামীণ রাস্তা: গ্রামাঞ্চলে, মাটির রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল যা বাজার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিকে সংযুক্ত করেছিল।
  • রেলপথ নির্মাণ: ১৮৫৪ সালে, কলকাতা থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম রেলপথ নির্মাণ করা হয়।
  • ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করে এবং 1947 সালের মধ্যে, বাংলায় প্রায় 5,000 কিলোমিটার রেলপথ ছিল।
  • জলপথ পরিবহন: নদীগুলি ছিল বাংলার প্রধান পরিবহন মার্গ।
  • ব্রিটিশরা নদীগুলিকে আরও নাব্যযোগ্য করার জন্য কাজ করে এবং নৌকা ও স্টিমার পরিষেবা উন্নত করে।
  • ডাক ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা: ব্রিটিশরা একটি দক্ষ ডাক ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে।
  • এটি দেশের বিভিন্ন অংশে যোগাযোগকে দ্রুত ও সহজ করে তোলে।

উন্নয়নের প্রভাব:

  • ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি: উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সাহায্য করে।
  • কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি: মালামাল সহজে বাজারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হওয়ায় কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
  • শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার: উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে সহায়তা করে।
  • নগরায়নের বৃদ্ধি: শহরগুলিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেলে নগরায়নের বৃদ্ধি ঘটে।

তবে, কিছু সমালোচনাও রয়েছে:

  • ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব স্বার্থে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করেছিল।
  • গ্রামীণ এলাকায় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন তেমন হয়নি।
  • ব্রিটিশ শাসনামলে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈষম্য ছিল।

পরিশেষে, বলা যায় যে ব্রিটিশ আমলে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল।

Share your love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *